বঙ্গবন্ধুর “জীবনী ” যত পড়ছি ততোই আবেগে আপ্লুত হচ্ছি। নিপীড়িত নির্যাতিত একটি জাতির মুক্তির জন্য এতো ভালোবাসা এতো ত্যাগ ইতিহাসে সত্যিই বিরল।  ১৯৬৬ সালের ৮ মের দিবাগত রাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির বাঁচার দাবি মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রদানের জন্য। দীর্ঘ ১৭ টি মাস তাকে ঢাকা কারাগারের ছোট্ট একটি কামড়ায় একাকী রাখা হয় , কারো সাথে যে মন খুলে একটু কথা বলবেন তার কোনো উপায় ছিলোনা।  তার উপর অতি নিকটেই ছিল “পাগলা গারদ” , সেখানকার পাগলদের চিৎকার আর হৈ হুল্লরে  রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতেন না। অথচ রাজবন্দী হিসাবে তাকে ডিভিশন দিয়ে অন্য বন্দিদের সাথে রাখার কথা। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে জেলের ভিতর অনেক বৈষম্যের কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন “জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে” !
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনীর জন্য কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি প্রয়াত বঙ্গমাতা ফজিলুতেন্নেছা মুজিবকে যার অসীম ত্যাগ এবং দুরুদর্শিতার জন্য বাঙালি জাতি আজ জানতে পারছে বঙ্গবন্ধুকে এবং স্বাধীনতার ইতিহাসকে আরো ভালো করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই জেল-জুলুম ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্য দিনের সঙ্গী। যৌবনের বেশিরভাগ সময় তিনি জেলে কাটিয়েছেন। তাই প্রতিবার যখন তিনি জেলে যেতেন , বেগম মুজিব একটি খাতা এবং কলম ব্যাগে ভরে দিতেন এবং সব সময় উৎসাহ দিতেন লেখার জন্য। বেগম মুজিবের দূরদর্শিতার প্রতীক সেই খাতা আর কলমের জন্য বাঙালি জাতি আজ জানতে পারছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী তথা বাংলাদেশের আত্মজীবনী !
একটি নিপীড়িত জাতির মুক্তির জন্য একজন নেতার যে সমস্ত গুন্ থাকার কথা , বঙ্গবন্ধুর মাঝে তার সবই ছিল। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে অনেক জাদরেল বাঙালি নেতার নাম আসে। কিন্তু কেউ সেই আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারেন নি। অনেকের প্রত্যয় ছিলোতো সাহস ছিলোনা , সাহস ছিলোতো প্রত্যয় ছিলোনা। আইয়ুবশাহীর চোখ রাঙানি আর জেল-জুলুমকে তারা ভীষণ ভয় করতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার ব্যতিক্রম। সাহস আর প্রত্যয়ের চমৎকার সমন্বয় ঘটেছিলো বঙ্গবন্ধুর জীবনে। আইয়ুব খানের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে পাঞ্জাবীদের শক্ত ঘাঁটি লাহোরে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাঙালিদের বাঁচার দাবি ৬ দফা। সেই সময় মাওলানা ভাসানী সহ কোনো বাঙালি নেতা ৬ দফার সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শুরে সুর মিলিয়ে তারা ৬ দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আজ বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা বলে মাওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে ওয়ালাইকুম সালাম বলে নাকি প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি যদি সত্যিই তা চাইতেন তা হলেতো বঙ্গবন্ধুর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ৬ দফার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কিন্তু তা না করে তিনি আইয়ুব খানের চাটুকারী করেছেন। মাওলানা ভাসানী যে কত সুবিধাবাদী নেতা ছিলেন তা বঙ্গবন্ধুর দুটো আত্মজীবনীতে আমরা দেখতে পাই।
বঙ্গবন্ধু যে কত দূরদর্শী নেতা ছিলেন  , তা তার আত্মজীবনী পড়লেই বুঝা যায়। ৬ দফার আন্দোলন তথা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু সহ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে বন্দি করেছিলেন , বঙ্গবন্ধুর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তার উপর চরম মানসিক অত্যাচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি থেমে যাননি , উল্টো আইয়ুব শাহিকে বলেছিলেন পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফা মেনে নাও , না হলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। পরবর্তীতে আমরা ঠিক তারি প্রতিফলন দেখলাম। আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতা তা মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে শেষ করতে যেয়ে আইয়ুব খান নিজেই শেষ হয়ে গেলেন ! আর তার পরের ইতিহাসতো সবারই জানা। ‘৬৬ র ৬ দফার জন্য ‘৬৮ র আগরতলা মামলা , আগরতলা মামলার জন্য ‘৬৯ র গণআন্দোলন আর গণআন্দোলনে আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ‘৭০ র নির্বাচন , যার নিরংকুশ জয়ে বাঙালি পেলো তার প্রাণের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ , বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে জানতে হলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জানতে হবে